ভাবলে সত্যিই অবাক লাগে, আমাদের জীবজগৎকে কি অপরূপ বর্ণিল করে সাজিয়ে রেখেছে প্রকৃতি তার দক্ষ হাতের সুনিপুণ ছোঁয়ায়! রঙের কারিগর, রঙিন চিত্রকর প্রকৃতির প্রতিটি সৃষ্টি ঠিক যেনো একেকটি শ্রেষ্ঠ শিল্পকর্ম! প্রকৃতির প্রতিটি পরতে পরতে যেনো ছড়িয়ে আছে রঙের খেলা! প্রকৃতির নাচিয়ে রাণী (Dancing queen), প্রজাপতির ডানার কথাই ধরা যাক! কি অপরূপ নান্দনিকতায় সাজানো প্রজাপতির ডানা, যার মোহে জাতীয় কবি নজরুল অমন রঙিন ডানা প্রাপ্তির আকাঙ্ক্ষায় লিখেছিলেন, ‘প্রজাপতি! প্রজাপতি!! কোথায় পেলে ভাই এমন রঙিন পাখা?’ শুধু কি নজরুলই প্রজাপতির রঙিন ডানার ঝলকে বিস্ময়ভরা চোখে জানতে চেয়েছিলেন এত রঙের উৎস? কিভাবে পেলো জীবজগৎ এমন অপরূপ রঙের ছোঁয়া? কি রহস্য আছে এর নেপথ্যে? কেনইবা জীবজগৎ এত বর্ণিল? এ প্রশ্নগুলো যুগে যুগে শুধু নজরুলের মতো শিল্পী মনকেই নয়, বরং ভাবিয়েছে ডারউইন, ওয়ালেস, পৌল্টন, হাক্সলি সহ অগণিত প্রকৃতিপ্রেমী ও জ্ঞান পাত্রের অমৃত সুধা আস্বাদনের স্পৃহায় কাতর, রহস্যপাগল মহান মনীষীদেরও। প্রাণিজগতে একটা অন্যতম ব্যাপার হলো, যৌন দ্বিরূপতা (sexual dimorphism), অর্থাৎ একটি প্রজাতির প্রাণির স্ত্রী ও পুরুষ সদস্য দেখতে ভিন্ন রকম হওয়া। শুধু আকার, কিংবা আকৃতিতেই নয়, যৌন দ্বিরূপতা পরিলক্ষিত হয় দেহের বর্ণবিন্যাসেও। অনেক প্রজাতিতেই, যেমনঃ ময়ূর, স্ত্রী ও পুরুষ সদস্যরা ভিন্ন ভিন্ন রঙে সজ্জিত। চার্লস রবার্ট ডারউইনের বিশ্বাস ছিলো প্রাণিদের বর্ণবিন্যাসে এমন যৌন দ্বিরূপতার কারণ বিপরীত লিঙ্গকে আকর্ষণ। অন্যদিকে সমসাময়িক আলফ্রেড রাসেল ওয়ালেস দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করতেন যে, এর কারণ আত্মরক্ষা ও প্রকৃতির সংগ্রামে টিকে থাকা। মজার বিষয় হচ্ছে বিভিন্ন সময়ের গবেষণায় অন্যান্য প্রাণিতে (যেমনঃ ময়ূর) ডারউইনের মতবাদের যৌক্তিকতার দেখা মিললেও প্রজাপতির ক্ষেত্রে ওয়ালেসের মতবাদটিই অধিকতর সমর্থনযোগ্য বলে বিবেচিত হয়েছে। কিভাবে তাহলে প্রজাপতিদের এমন দ্বিরূপ বর্নবিন্যাসের দ্বারা ওরা আত্মরক্ষা করে শিকারী প্রাণীদের হাত থেকে? এ বিষয়েই একটু আলোচনা করা যাক! ‘কমন মরমন’ (Papilio polytes) নামে এক প্রজাতির প্রজাপতি পাওয়া যায় আমাদের দেশে, যারা সম্পূর্ণ নির্বিষ। এ প্রজাপতির ডানার বর্ণবিন্যাসে চমৎকার যৌন দ্বিরূপতা পরিলক্ষিত হয়। পুরুষ সদস্যদের ডানার সিংহভাগ জুড়ে দেখা যায় কালোর আধিক্যের মাঝে সাদা রঙের ছোপ, অন্যদিকে স্ত্রী সদস্যরা বহু রঙে রঙিন ও ছলনাময়ী। আমাদের দেশের স্ত্রী ‘কমন মরমন’ প্রজাপতির ডানার বর্ণবিন্যাস এদেশে প্রাপ্ত ‘কমন রোজ’ (Pachliopta aristolochiae) নামক আরেক প্রজাতির প্রজাপতির মতো যারা শুঁয়াপোকা দশায় ঈশ্বরমূল, ঘুঘুলতার মতো বিষাক্ত উদ্ভিদ খায় বলে পূর্নবয়স্ক অবস্থাতেও বিষাক্ত (মানুষের জন্য নয়)। কারণ এসব উদ্ভিদে এরিস্টোলচিক এসিড (aristolochic acid) নামক এক ধরণের বিষাক্ত রাসায়নিক পাওয়া যায় যা এসব প্রজাপতির শুঁয়াপোকার দেহে আত্তীকৃত (assimilation) হয়ে থাকে। বিষাক্ত কমন রোজের ডানার অমন ঝলমলে বর্ণবিন্যাসের দ্বারা এরা মূলত পাখী, টিকটিকি ও অন্যান্য সরিসৃপ সহ শিকারী প্রাণিদের সতর্কবার্তা দেয় এই বলে – ‘আমি বিষাক্ত, আমার ধারেকাছে এসো না’। এই সতর্কবার্তার বিষয়টিই অনুকরণ করে ‘কমন মরমন’ প্রজাপতির স্ত্রী সদস্যরা। বিষাক্ত না হলেও ডানার বর্ণবিন্যাস বিষাক্ত কমন রোজের মতো বলে এরা বেঁচে যায় শিকারীদের হাত থেকে। কি দারুণ রঙের ছলাকলা! জীববিজ্ঞানের ভাষায় কমন রোজ প্রজাপতির মতো অন্যান্য বিষাক্ত প্রাণিদের এমন উজ্জ্বল বর্ণবিন্যাসের দ্বারা নিজের বিষাক্ততার বার্তা দেয়ার বিষয়টিকে বলা হয় অ্যাপোসেমাটিজম (aposematism)। আবার কমন মরমনের মতো এক প্রজাতির প্রাণীর দ্বারা অন্য প্রজাতির বা নিজ প্রজাতির বিপরীত লিঙ্গের সদস্যের দৈহিক গঠন, বর্ণবিন্যাস, আচরণ ইত্যাদি অনুকরণ করার বিষয়টিকে বলা হয় মিমিক্রি (mimicry)। প্রশ্ন হলো, কেনো শুধু স্ত্রী কমন মরমন প্রজাপতিই বিষাক্ত কমন রোজকে অনুকরণ করছে, যেখানে পুরুষ সদস্যদের মাঝে এমন অনুকরণ, তথা মিমিক্রি দেখা যায় না? উত্তর খুব সহজ, পেটভর্তি ডিম সমেত স্ত্রী সদস্যরাই প্রকৃতপক্ষে সবচাইতে বেশী বিপদগ্রস্থ তথা ভালনার্যাবল। তাই শিকারী প্রাণীর হাত থেকে বাঁচতে বিবর্তনের গতিপথে স্ত্রী সদস্যরাই অর্জন করেছে এমন ছলনাময়ীতা!
![](https://static.wixstatic.com/media/1da808_6797059fda31403dbf6951d58848cf16~mv2.jpg/v1/fill/w_604,h_241,al_c,q_80,enc_avif,quality_auto/1da808_6797059fda31403dbf6951d58848cf16~mv2.jpg)
ছবিঃ কমন মরমোন (বাম পাশে) স্ত্রী ও কমন রোজ প্রজাপতির ডানার সাদৃশ্যতা
(উৎসঃ Nishikawa et al)
অবাককর বিষয় হচ্ছে, স্ত্রী কমন মরমনের ডানার এমন ছলনাময়ীতার পেছনে লুকিয়ে আছে A-T-C-G তথা জিনের ছলাকলা! কীটপতঙ্গদের লিঙ্গ নির্ধারণে doublesex নামক একটি জিনের ভূমিকা রয়েছে। প্রকৃতকোষী সকল জীবের জিনের একটি অন্যতম বৈশিষ্ট্য হচ্ছে- সিংহভাগ জিনের স্থানে স্থানে দেখা যায় ইন্ট্রন নামক নন-কোডিং অংশ আর তাইতো ট্রান্সক্রিপশনে সৃষ্ট mRNA-কে রাইবোসোমের মাঝে প্রোটিন উৎপাদনের লক্ষ্যে প্রেরণের পূর্বে কেটে বাদ দিতে হয় এই নন-কোডিং ইন্ট্রন অংশগুলোকে। স্বাভাবিকভাবে এ কাটাকাটির বিষয়টি স্প্লাইসিং (splicing) নামে পরিচিত। স্প্লাইসিং এর মুহুর্তে কাটাকাটিতে কোনো ভিন্নতা দেখা গেলে বদলে যাবে প্রোটিনের গঠন তথা জীবের বৈশিষ্ট্য। উদাহরণস্বরূপ ধরা যাক ‘ছবি খ’, যেখানে পাঁচটি কোডিং এক্সন (Exon 1 থেকে Exon 5) ও এদের মাঝখানে মাঝখানে নন-কোডিং ইন্ট্রন নিয়ে গঠিত একটি জিন হতে সৃষ্ট প্রাক mRNA-কে কেটে ইন্ট্রন অংশগুলো বাদ দিয়ে রাইবোসোমে প্রেরণের উপযুক্ত করা হচ্ছে। কাটাকাটির এ মুহুর্তে একাধিকভাবে বিন্যাস (combination) গঠন সম্ভব।
![](https://static.wixstatic.com/media/1da808_06f2883536834aeaa0af6c3024d8a599~mv2.jpg/v1/fill/w_980,h_569,al_c,q_85,usm_0.66_1.00_0.01,enc_avif,quality_auto/1da808_06f2883536834aeaa0af6c3024d8a599~mv2.jpg)
ছবিঃ অল্টারনেটিভ স্প্লাইসিং
(উৎসঃ উইকিমিডিয়া কমনস)
ছবিতে দেখা যাচ্ছে তিনভাবে কাটার দৃশ্য (কখনো শুধু ইন্ট্রন অংশগুলো কেটে বাদ দেয়া, আবার কখনো ইন্ট্রনের পাশাপাশি এক্সনও কেটে বাদ দেয়া) আর যার জন্য পরিশেষে তিন ধরণের প্রোটিন তথা বৈশিষ্ট্য সৃষ্টি হচ্ছে। জিনতত্ত্বের ভাষায় প্রাক mRNA-কে এমন ভিন্ন ভিন্নভাবে কেটে ভিন্ন ভিন্ন বিন্যাস গঠনের বিষয়টিকে বলা হয় অল্টারনেটিভ স্প্লাইসিং। স্ত্রী কমন মরমনের ডানার অমন ছলনাময়ী বর্ণবিন্যাসের কারণও doublesex জিন হতে সৃষ্ট mRNA-র কাটাকাটির ভিন্নতা (alternative splicing)। কি অদ্ভুত তাই নয় কি! লিঙ্গ নির্ধারণের জিন দিয়েই ডানার বর্ণবিন্যাস নিয়ন্ত্রণ! যেনো এক ঢিলে দুই পাখি!
তথ্যসূত্রঃ ১. Kunte, K. 2008. Mimetic butterflies support Wallace’s model of sexual dimorphism. Proc. R. Soc. B. 275: 1617-1624. ২. Kunte, K. et al. 2014. doublesex is a mimicry supergene. Nature 507: 229–232. ৩. Zou, M. et al. 2011. The Roles and Evolutionary Patterns of Intronless Genes in Deuterostomes. Comparative and Functional Genomics 680673: 1-8.
Comments